- বিনোদ ঘোষাল
সাহিত্যিক
যুদ্ধক্ষেত্রে এক যুবক রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে চলেছেন। এমন𒆙 কি কেউ কখনও দেখেছে? ততদিন পর্যন্ত রবিবাবু যত গান লিখেছেন, সব মুখস্থ ওই তরুণের, একেবারে স্বরলিপি সমেত!
আরেকবারের ঘটনা। ওই তরুণের বয়স তখন একটু কম। দুখু ব🔯লে ডাকে বন্ধুরা। খেলার মাঠে দিব্যি খেলা চলছে। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের নাম তুলে কুকথা বলে বসল এক খেলোয়াড়। কথাটা ভীষণ গায়ে লাগল দুখুর। মেজাজ গেল বিগড়ে। গোলপোস্টের বার তুলে ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিল। পরে এই কিশোরকেই বাংলা চিনল কাজী নজরুল ইসলাম নামে।
১৯২২ সাল নাগাদ ব্রিটিশ বিরোধী কবিতা লেখার জন্য জꦏেল খাটছেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথ সেই প্রথম ঠাকুর পরিবারের কাউকে বই উৎসর্গ না করে উৎসর্গ করলেন এক বাইশ তেইশ বছরের যুবককে। ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যের উৎসর্গপত্রে লিখলেন ‘শ্রীমান কবি কাজী নজরুল ইসলামকে’!
- নজরুলের প্রশ্রয়দাতার ভূমিকায়
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ‘কে বাজায় বাঁশি’ লেখার সময় বারবার আমাকে ধরা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এক অন্য রবীন্দ্রনাথ তিনি। কখনও তরুণ কবি নজরুলের প্๊রশ্রয়দাতার ভূমিকায়, কখনও আবার দুখু মিঞাকে আড়াল করতে নিজের সাহিত্যের উদাহরণ দিতেও অকুণ্ঠিত। নজরুলকে বই উৎসর্গ করায় অনেকেই প্রতিবাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যুত্তর ছিল— নজরুলের লেখা তোমরা হয়তো অনুধাবন করতে পারোনি বা সে লেখাকে উপেক্ষা করেছ। একজন তো গুরুদেবকে বলেই বসলেন— নজরুলের লেখা হুজুগের লেখা। যুগের সঙ্গে সঙ্গে তো একসময় এগুলো হারিয়ে য𓄧াবে। রবীন্দ্রনাথ তখন অমোঘ উত্তর দেন; বলেন, আমার যদি ওঁর মতো বয়স হত, কে জানে আমি হয়তো ওঁর মতোই লিখতাম!
একটা নয়, এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। নজরুল যখন অর্থকষ্টে, রবীন্দ্রনাথ তাঁক▨ে ডেকে শান্তিনিকেতনে চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করছেন; নজরুল পত্রিকা করছেন, তিনি✱ আশীর্বাণী লিখে দিচ্ছেন। একজন প্রবীণ কবি তথা লেখক একজন নবীন কবিকে এই যে অনবরত প্রশ্রয় দিচ্ছেন ও আগলে রাখছেন, এখনকার যুগের লেখকদের কাছে এ জিনিস নিঃসন্দেহে বড় দৃষ্টান্ত।

- সুপারিশ লিখে দিলেন সমালোচক সজনীকান্তকে
নজরুলের পাশাপা💎শি সজনীকান্ত দাশের কথাও এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। ‘শনিবারের চিঠি’তে সজনীকান্ত কোনও লেখককেই কটাক্ষ করতে ছাড়তেন না। একবার রবীন্দ্রনাথের এক লেখাকেও তিনি তুলোধোনা করলেন। গোটা সাহিত্য জগত রে রে করে উঠল। ছদ্মনামে লিখলে কী হবে, ততদিনে ওই লেখা কে লিখেছে, তা জানতে আর বাকি নেই। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত আহত হয়েছিলেন। যে সজনীকান্ত এত কাছের, সে কি না এমন করল! কিন্তু মুখে কোনও রা কাড়েননি গুরুদেব। এর কিছু দিন পরের ঘটনা। সজনীকান্তের একটা চাকরির খুব দরকার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক জায়গায় চাকরি হয়ে গিয়েছে প্রায়, কিন্তু সুপারিশ চাই একজনের। কার? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অগত্যা সজনী তখন চিঠি লিখলেন কবিকে। ‘আপনার একটি সুপারিশপত্র পেলে আমার চাকরিটা হয়ে যায়।’ রবীন্দ্রনাথ ভাববার জন্য এক মুহূর্তও নষ্ট করেননি। সঙ্গে সঙ্গে লিখে দিলেন— বাবু সজনীকান্ত দাশ বাংলায় অত্যন্ত দক্ষ। আমি মনে করি, বাংলা ভাষায় তাঁর মতো ব্যুৎপত্তি খুব কম ব্যক্তির রয়েছে। সর্বান্তকরণে আমি তাঁর উন্নতি কামনা করি।
- পেয়েছি গভীর সহনশীল রবীন্দ্রনাথকে
একদিকে যেমন প্রশ্রয়দাতা হিসেবে, অন্যদিকে তেমনই গভীর সহনশীল রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি তাঁর নানা কাজের মধ্যে দিয়ে। শুধু নজরুল বা সজনীকান্ত নন, আমার জীবনেও তাঁর গভীর ভূমিকা রয়েছে। মফস্বলের মধ্যবিত্ত বাড়ি আমাদের। জ্ঞান হওয়া পর থেকেই দেখেছি বাড়িতে তিনটে ছবি টাঙানো - রাধাকৃষ্ণ, শ্রীরামকৃষ্ণ ও তারপর এক দাড়িওয়ালা মানুষ। বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম উনি রবি ঠাকুর। ঘুম থেকে উঠেই আমাদের নিয়ম ছিল প্রথমে এই তিনটে ছবিকে প্রণাম করা। প্রথম প্রথম মনে প্রশ্ন আসেনি। তার পর আস্তে আস্তে ঠাকুমার ঘরে দেখতে পেলাম বিচিত্রা, বলাকা বইগুলো; ঠাকুমা সুর করে পড়তেন। বাবা বাড়িতে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। দিদি রবীন্দ্রসংগীত শেখা শুরু করল। এভাবেই সম্পূর্ণ বোধ হওয়ার আগে থেকে ⛄রবি ঠাকুর বলে যে একজন মাথার উপরে আছেন, ঠাকুরের মতোই আছেন, সে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল! শুধু আমার বাড়ি নয়, ছোটবেলার বন্ধু বা পরিচিত কারওরই বাড়িই এমনটা দেখিনি যেখানে রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি নেই, সে মূর্তি হোক বা একটি বাঁধানো ফটো।
- পাড়া কালচারে রবীন্দ্রনাথ
একেবারে শৈশব থেকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের চেতনাসঙ্গী ছিলেন। প্রথমে ‘শিশু ভোলানাথ’-এর মতো কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে তাঁকে চিনেছিলাম। এরপর একটা সময় নাটকে অভিনয় শুরু করলাম। তোতাকাহিনি বা ডাকঘর নাটকগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে না পারলেও একটা বাহ্যিক আরাম পেতাম। পাড়াতে তখন যে রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা হত, সেগুলির গুরুত্ব এখ🍬ন বুঝি। আমাদের মননের দ্বেষ, হিংসার উপর রবীন্দ্রনাথের ভাবনা, আদর্শ কীটনাশকের মতো স্প্রে করে শুভ চিন্তাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হত। বাংলার আবহের মধ্যে তখন রবীন্দ্রচর্চা বেশ গভীরভাবে ছিল। ‘ছিল’ বলছি কারণ পাড়া কালচারে এই যে অনুষ্ঠান হলেই রবীন্দ্র সংগীত, বাড়িতে বাড়িতে সন্ধে হলেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া, বুঝে গাইছে কি না বুঝে গাইছে পরের ব্যাপার, এগুলো কিন্তু নিয়মিত হ𒆙ত। মোবাইল ফোন ছিল না বলে আমরাও নিরলস, নিরন্তরভাবে এসবের সঙ্গে যুক্ত থাকতাম।
এরপর যখন আস্তে আস্তে জ্ঞানগম্যি বাড়ল, রবীন্দ⭕্রনাথকে আবিষ্কার করলাম তাঁর ছিন্নপত্র ও রাশিয়ার চিঠি থেকে; মূলত প্রবন্ধ থেকে🐼। ওগুলো পড়ে আমার কৈশোর বা পরিনত যৌবনের সময় হঠাৎ করে যেন রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করলাম। ‘আরেহ! এই মানুষটা এরকম!’ অজ্ঞানবশত যে শ্রদ্ধা ছিল তাঁর প্রতি, এবার তা জ্ঞানত হল, মুগ্ধতা বাড়ল তাঁকে ঘিরে।
- একেকটা গান যেন হীরকখণ্ডের মতো
তাঁকে চেনার যাত্রা শুরু হল যখন, তখন একে একে অন্য লেখাগুলিও পড়তে শুরু করলাম। নাটক, কবিতা, গান। রবীন্দ্রনাথের একটি গান ষোলো ব𓆏ছর বয়সে একরকম লেগেছিল, আবার আজ পঞ্চাশ বছর বয়সে আরেকরকম। তাঁর একেকটা গান যেন হীরকখণ্ডের মতো। শুধু মূল্যের নিরিখে নয়। হীরকের একেকটি তলে একেকরকম আলো বিচ্ছুরিত হয়। মানুষের একেকটি বয়সও যদি ওই একেকটি তলের মতো ভাবি, তাহলে রবীন্দ্রনাথের গান একেকবার একেকরকম আলো নিয়ে সেখানে ধরা দেয়। তরুণ বয়সে ‘চিরসখা হে’ যেভাবে🗹 আবিষ্কার করেছি, আজ অন্যভাবে আবিষ্কার করছি সে গান। যদি সত্তর বছর বাঁচি, তাহলে হয়তো আরেক অর্থে গিয়ে উপনীত হব। রবীন্দ্রনাথ এমনই বহুমাত্রিক আমার কাছে। তাঁর সৃষ্ট শিল্পসাহিত্য যেন আশ্চর্য সব খনি, খুঁড়তে শুরু করলে আর তল পাওয়া যায় না।
প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব
(অনুলিখন - সংকেত ধর)