কারাকোরামে ওরা কারা?
১
২০২২সালের ২💝২ জুলাই, কে-টু-র বুকে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিল।
‘স্যাভেজ মাউন্টেন’ নামে পরিচিত সেই🥂 ভয়াল পর্বত— যেখানে এক সময় গুটিকয়েক পর্বতারোহীই পা রাখার সাহস করতেন— সেদিন একদিনেই ১৪৫ জন মানুষকে তার চূড়ায় দাঁড়াতে দেখা গিয়েছিল।
দেখা গিয়েছিল, কে-টু-র সামিটের পথে, বটলনেকের সংকীর্ণ বরফের ঢালে রঙিন জ্যাকেট পরা পর্বতারোহীদের দীর্ঘ সারি। যেন কোনও সিনেমা হলে টিকিটের জন্য ভিড়, কিংবা তারকে🦹শ্বর মন্দিরে বাবার মাথায় জল ঢালার লাইন!
K2-র Bottleneck হল ৮২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত একটি সরু বরফের ঢাল। এর ওপরে ঝুলে থাকা বরফের স্তম্ভ যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে এবং পড়েও। ২০০৮-এ এখানেই ১১ জন মারা গিয়েছিলেন। তဣবুও, চূড়ায় ওঠার জন্য মানুষ Bottleneck পেরিয়ে যায়। কারণ, পথ এই একটিই।
নেপালে হিমালয়ের বুকে, এভারেস্ট ইত্যাদি আরও কয়েকটি ৮০০০ মিটারের শিখরে, ফি বছর যে ট্রাফিক জ্যাম হয়, তা দেখে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। তাই কেউ আর খুব একটা অবাক হন না। কিন্তু, কয়েক দশক আগেও, এভারেস্টের শীর্ষে পৌঁছোনো মানেই ছিল ꦐঅসাধারণ এক অ্যাচিভমেন্ট। আর এখন, মাউন্টেনিয়ারিং ট্যুরিজমের প্রকোপে, সেটা যেন শুধু আর একটা 'লাইকযোগ্য' কনটেন্ট।
কিন্তু কে-টু ছিল আলাদা। কঠিন, বিপজ্জনক, প্রতিকূল—এতদিন পর্যন্ত এটাকে ভাবা হত একদম চূড়ান্ত শৃঙ্গ। এমন একটা জায়গা, যেখানে যেতে গেলে কেবল🐟 সাহস থাকলেই হয় না— চাই অভিজ্ঞতা, ঠান্ডা মাথা আর ঝুঁকি বোঝার ক্ষমতা। ঠিকভাবে পা ফেলতে জানাটাই অনেক সময় জীবন বাঁচিয়ে দেয়। কেবল ট্যাঁকের জোরে কে-টু চড়া অসম্ভব ছিল।
আর সেই জায়গাতেই একদিনে ১৪🐠৫ জন পর্বতারোহীর লাইন ধরে ওঠা— তাও Bottleneck-এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ পথে! এভারেস্ট না হয় সয়ে গিয়েছে, তাই বলে কে-টু-তে ট্র্যাফিক জ্যাম? সেটা তো ভাবাই যায় না। এই দৃশ্যটাই ছিল আসল বিস্ময়। এটাই ছিল সেই ‘অভাবনীয় ঘটনা’।
২
যাই হোক, সেদিন কে-টুতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবু, অভিজ্ঞ পর্বতারোহীদের মনে ছড়িয়ে প🅠ড়েছিল অস্বস্তি আর একরাশ উদ্বেগ। কারণ সকলেই বুঝেছিলেন— এই🐻 'সফলতা' ছিল মূলত আবহাওয়ার দয়ায়, নিছক এক দিনের সৌভাগ্য।
বিশিষ্ট পর্বত বিশ্লেষক অ্যালান আর্নেট একে স্ဣপষ্টভাবে বলেছিলেন: ‘এটা নিছক সৌভাগ্য। আবহাওয়া এ✃কটু খারাপ হলেই একদিনে ২০–৩০ জনের মৃত্যু হতে পারত।’
নেটফ্লিক্স খ্যাত নিমস দাইয়ের একটি পোস্ট শেয়ার করে ব্রায়ান হল মন্তব্য করেছিলেন: ‘Mountaineering has become a goal-orientated pursuit where style and ethics have been discarded by using the m💙aximum resources available particularly for the clients, who totally rely on fixed ropes, oxygen and everything prepared and carried by a team of highly organised guides... I view it as (perhaps through outdated eyes), like competing in the Tour de France with an electric bike.’
পর্বতারোহণের ইতিহাসে যাঁর একটু হলেও হাতেখড়ি হয়েছে, বা পর্বতারোহণ সাহিত্য পড়তে গিয়ে যাঁর সঙ্গে এই জগতের সামান্য আলাপ হয়েছে—🏅 তাঁরা জানেন, কে-টু ছিল এক সময় পর্বতারোহনের চূড়ান্ত মানদণ্ড। এটা ছিল এমন এক শৃঙ্গ, যেখানে পৌঁছোনো মানে ছিল নিঃসঙ্গ সাধনা, দম, দক্ষতা আর কৌশলের ক༺ঠিনতম পরীক্ষা।
কিন্তু ২০২২-এর ২২ জুলাই সেই ধারণাটিকে এক ধাক্কায় মাটিতে এনে ফেলেছিল। গাইড-নির্ভরতা, ভিড় আর 'সামিট সেলফি'-র হইচই মিলে কে-টুও শেষে শিকার হয়েছিল টুরিস্ট মাউন্টেনিয়ারিং-এর। অভিযানের বিশুদ্ধতা অ্যাভালাঞ্চে চাপা পড়ে গিয়েছিল, ইন্সটাগ্রামের হ্যাশট্যা🏅গ জয়ের হাসি হেসেছিল।
কারণ আজকের দিনে, পর্বতারোহণ আর দুর্গম অভিযান নয়— এটা হয়ে গিয়েছে একটা পরিষে🦋বা, একটা অভিজ্ঞতা-পণ্য, যেটা সাজিয়ে বেচা হয়। আর যাঁরা সেসব ‘পণ্য’ প্যাকেজ করে তুলছেন, তাঁদের হাতেই উঠে এসেছে টুরিস্ট মাউন্টেনিয়ারিং-এর স্টিয়ারিং। এই ধরনের পর্বতারোহণ অনেকটাই সাজানো দৃশ্য। সব কিছু আগে থেকে গাইড আর সাপোর্ট টিম ম্যানেজ করে দেয়, দড়ি বাঁধা থাকে, অক্সিজেন রেডি থাকে—ক্লায়েন্ট থুড়ি, পর্বতারোহী শুধু এসে ওঠেন। যেন একর♚কম শো চলছে, দর্শকদের দেখানোর জন্য। লক্ষ্য একটাই— ‘সামিট হয়েছে’ এই ছবিটা তুলতে হবে। এভারেস্টের এই হাল দেখাই ছিল, এবার কে-টুও বাকি রইল না।
বুঝতেইপারছেন, একজন প্রক⛎ৃত পর্বতারোহীর চোখে এটা কেবল দৃষ্টি🌠কটু নয়—কষ্টেরও ছিল।
৩
কিন্তু এই গোটা বিশৃঙ্খলার মাঝে, আমাদের জন্য রয়ে গেল এক বিচিত্র স্বস্তি— কে🐽-টুর বরফের ঢালে সেই নির্লজ্জ মিছিলে আমরা, অর্থাৎ, কোন ভারতীয় ছিলামই না। এভারেস্ট-লোৎসে-তে? ছিলাম, অবশ্যই ছিলাম, বিপুল সংখ্যায় ছিলাম। কিন্তু, কে-টুতে নৈব নৈব চ।
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, এ কোনও একটা বিশেষ পর্বতের প্রতি আমাদের অতিরিক্ত শ্রদ্ধা বা climbing ethics-এর উদাহরণ নয়। এর♈ একমাত্র কারণ—আমাদের সেখানে যাওয়ার যো নেই। তাই ‘কারাকোরামে ওরা কারা’, এই জটায়ুময় প্রশ্নের এক খণ্ড উত্তর হল, ওঁরা আর যাই হোক, ভারতীয় নন।
কে-টু সহ এই অঞ্চলের বেশিরভাগ উচ্চ শৃঙ্গ পড়ে গিলগিট-বাল্টিস্তানে, পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায়। দীর্ঘদিনের ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত বিরোধ,যুদ্ধ, আর দুই দেশের পারস্পরিক অবিশ্বাস- সবাই মিলে আমাদের প্রাণপণে আটকে রেখেছে। যেতে নাহি দিব! ভিসা নেই, করিডোর নেই, নেই কূটনৈতিক ইচ্ছাশক্তি। ফলে কে-টু, নাংগা পর্বত বা ব্রড পিক আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে কেবল দূর থে𒊎কে দেখা ছবির মতো। পর্বতারোহী হিসেবে একটা আক্ষেপ হয় বইকি। তবে, এটাও ঠিক যে, সেদিন কে-টুতে সেই অক্ষমতাই আমাদের অজান্তে মুখরক্ষা করেছিল। এ যেন এক নিষিদ্ধ সৌন্দর্য— যেখানে নিষেধাজ্ঞাই আশীর্বাদ।
৪
কেন এমন কথা বলছি? আমরা ভারতীয়রা কি সত্যিই এতটা খারাপ? না, ব্যাপারটা তা নয়। কিন্তু প্র🅠শ্নটা হল— যদি সুযোগ থাকত? যদি কারাকোরামও নেপালের মতো, বা আমাদের দ𝕴েশের কেদারকাঁটা, স্টক কাঙরি বা সন্দকফুর মতো, সহজলভ্য হত? তাহলে কি এর পরিণতি আর পাঁচটা 'ট্রেকিং মেলা'-র চেয়ে খুব আলাদা হত?
সাম্প্রত𒀰িক ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে— ভারতীয় হিমালয়ে যেখানেই ‘অ্যাডভেঞ্চার প্যাকেজ’-এর ছোঁয়া লেগেছে, সেখানেই পাহাড়ের নীরবতা, নদীর নির্মলতা, বনভূমির প্রাণ—সবই গিয়েছে হারিয়ে। কাশ্মীর গ্রেট লেকস এখন প্লাস্টিকের ঠোঙা, নিঃসঙ্গতা আর শৌচকর্মের ছড়াছড়িতে বিধ্বস্ত। স্টক কাঙরি-তে এত ভিড় হয়েছে যে স্থানীয়রা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছেন ট্রেক। কেদারকাঁটা আর সন্দকফুতে চলছে ডি🐬জে পার্টি, ক্যাম্পফায়ারের ধোঁয়া যেন জ্বলন্ত বিবেকের ধ্বংসস্তূপ।
মনে করুন, যদি কারাকোরামের পথ খুলে যেত— তাহলে হয়তো আমরা দেখতে ღপেতাম 'সামিট সেলফি পয়েন্ট', প্রি-বুকড ভিআইপি রেস্ট 𝓀জোন, আর হেলিকপ্টারে করে ‘নাঙ্গা পর্বত দর্শন যাত্রা’। টেন্টে থাকা নয়— ওখানে থাকত গ্ল্যাম্পিং ব্যাবস্থা, চার পদের খিচুড়ি আর ইনফ্লুয়েন্সারদের মেটা-রিল। আসলে, আমরা শুধু প্রকৃতিকে জয় করতে চাই না— ব্র্যান্ড বানিয়ে বাজারে ছাড়তে চাই।
৫
তাই, আমাদের মহানুভবতাকিংবা সদিচ্ছায় নয়, কারাকোরাম রক্ষা পেয়েছে আমাদের অক্ষমত🔯ায়। হয়তো এটাই ভালো। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে আমরা জানি না। শিখিনি কোনও দিন। আমরা জানি কেবল দেবতা বানিয়ে, তার গাল ভরা নাম দিয়ে, মন্ত্র আউড়ে, ভক্ত এবং ভগবানের মধ্যে একটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি লিখে🌼 ফেলতে।
তাই, হয়তো আমাদের উচিত, পর্বতকে আবার সেই পুরনো, থুড়ি, ‘সনাতনী’ ভাবে দেখা—উপাসনার বস্তু হিসেবে। আমাদের উচꦐিত সব শৃঙ্গের বেস ক্যাম্পে একটা করে মন্দির বানানো, হাই অল্টিচিউড পোর্টার👍ের বদলে হাই আল্টিচিউড পুরুত নিয়োগ করা, আর চালু করা ‘অমুক শৃঙ্গ দর্শন যাত্রা—VIP পাস সহ’ টাইপের বিশেষ প্যাকেজ!
এতে বিশ্বাস, বাণিজ্য, আꩵমলাতন্ত্র—এধর্ম রাজ্যে সবই অটুট থাকবে। থাকবে না কেবল পর্বতারোহণের অন্তর্নিহিত সাধনার নামে অসভ্য আস্ফালন। এতে হিমবাহের ওপর বাবুদের শেরপা সর্বস্ব দাপাদাপি কমবে। ক্লাইমেট ক্রাইসিস ও সামলানো যাবে। হাই- অল্টিচিউডেও ভারতীয়রা নিজেদের সংস্কারি এলিমেন্টে থাকতে পারবেন। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।
আর কারাকোরামের সেই পাহাড়গুলি— সেই শীতল, নীরব সত্তাগুলি, আমাদের গর্বোদ্ধত কোলাহল থেকে দূরে থেকে, নিজেদের নীরব গরিমায় অবিচল দাঁড়িয়ে থাকবে। আর আমরা, দুই পক্ষের নাগরিকেরা, সেই নীরব পাহাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকব শুধুই অনুমতির অপেক্ষায়, যেমনটা সব সময় থেকেছি—নিজেদেরই ভূখণ্ডে পর✱বাসী হয়ে।
প্রকৃতিধ্বংসের খে🐟লায় আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। দেখেও না 🌳দেখার খেলায় গোল্ড মেডেল আমাদের বাঁধা। আমাদের সব কিছু সয়ে যায়। কেটু-র মিছিল তো কোন ছার।
(মতামত ব্যক্তিগত)