খুব ছোটবেলা থেকেই নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নারী সত্ত্বা বুঝতে পেরেছিলেন অভিষেক কর। তবে বাবা-মা ছেলের এই দিকটা মেনে নিতে পারেননি খোলা মনে। তাই অভিষেক থেকে বন্যা হওয়ার যে লড়াই, তাতে সঙ্গ ছেড়েছে পরিবার। এখন তিনি থাকেন একলা। যদিও ভালোবাসার মানুষ কম নেই, তবুও পরিবার ছাড়া থাকার যন্ত্রণা হামেশাই ফুটে ওঠে তাঁর লেখাতে।
সম্প্রতি নিজের ফেসবুক পোস্টে রূপান্তরকামী বা রূপান্তরিত মানুষদের জন্য বন্যা দিলেন বড় বর্তা। লিঙ্গ পরিবর্তনের অপারেশন করানোর আগে দরকার নিজের পায়ে দাঁড়ানো। সঙ্গে কীভাবে ছোটবেলা থেকে ঘাত-প্রতিঘাতের মুখে পড়েছেন, তা নিয়েও বললেন কথা।
বন্যা লেখেন, ‘২০১৬-তে এক পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে যখন জানিয়েছিলাম আমি পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট, আমার বাবার এক পাড়াতুতো ভাই বাড়িতে এসে বলেছিল, 'বাবাই এসব কাস্টমার ধরার জন্য করছে। লাল্টিদা হয়তো ওকে হাতখরচ দেয় না, তাই এইভাবে টাকা ইনকাম করবে'।
যেদিন প্রথম আইব্রাও প্লাক করেছি, মা বলেছিল 'পরেরদিন ঢোল নিয়ে বেরিয়ে পড়িস'। তারপর প্রথম কেনা ব্রা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। শাড়ি পরা ছবি দেখতে পেয়ে মুখের সামনে থেকে দুপুরের খাবার কেড়ে নেয়। বাড়িতে বসে কবিতাপাঠ করতাম যখন, তখন পাশের ঘরে জোরে জোরে গান চালিয়ে দিত, অগত্যা মাঝেরাতে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠে কবিতা পাঠ করতাম।’
কখনো গরমকাল ফ্যান বন্ধ করে দেওয়া, কখনো খেতে না দেওয়া, নানারকম অত্যাচার করত বলেই বন্যা জানিয়েছেন তাঁর ফেসবুক ওয়ালে। লেখেন, ‘গরমকালে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছি, যেই অফিস শেষ হতো পাখা বন্ধ করে দিতো। অফিস চলাকালীন কিছু বলত না, কারণ মাস শেষে আমি তো অফিস করেই ঘরে টাকা দিতাম। ঘরে টাকা দেওয়ার পরও পরিস্থিতি এমন করে তোলা হতো যে দিনের পর দিন সন্ধ্যাবেলায় বাইরে থেকে এগরোল খেয়ে বাড়ি ফিরতাম’। এরপর বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সেখানেও শান্তি নেই। পাড়া-পড়শিদের কাছে গিয়ে বন্যার বাড়ির লোক বলতেন, ‘বাড়িতে থেকে তো হিজড়া হতে পারছিল না তাই বেরিয়ে গেছে’।
বন্যা জানান, প্রেম এসেছে তাঁর জীবনে। একাধিক মানুষ রূপে মুগ্ধ হয়ে দিয়েছে ভালোবাসার প্রস্তাব। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউই আসলে স্বীকৃতি দিতে রাজি ছিল না। লিখলেন, ‘মেসেজ বক্সে প্রেম নিবেদনের ছড়াছড়ি... কিন্তু এদের মধ্যে এক শতাংশও স্বীকৃতি দিতে চায়নি, সংসার করতে চায়নি, একজন তো রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতেটুকু চায়নি! আর যে একজন বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিল, সে ৩৪০০০ টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিল।’
এরপর সমস্ত রূপান্তরকামী মানুষগুলোর আওয়াজ হয়ে ওঠা বন্যা লিখলেন, ‘বয়স বাড়ে, শরীরের রোগ ধরে, মৃত্যু বা মৃত্যু যন্ত্রণা আসন্ন হয়ে পড়ে। ছোটোখাটো রোগ হলেই আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি এরপর? যদি অন্য একজন মানুষ হতাম, আর কিছু না হোক শরীর খারাপের খবর পেলে পরিবারের কোনো একজন তো ছুঁটে আসত! আমাদের তো কপাল এমনই যে, আমরা মরে গেলেও আমাদের অনেকের পরিবার দেহ সনাক্ত করতে চায় না, আমাদের মৃত্যুকেও ওরা ডিজ্ওন করে। ফলে প্রত্যেকটি মধ্যবয়স্ক রূপান্তরিত বা রূপান্তরকামী মানুষের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে যে 'অসুস্থ হলে দেখবে কে? মরার সময় জলটুকু দেবে কে'?’
আর এই প্রসঙ্গেই বন্যার উপদেশ, ‘আমি চাই এই ভয় যেন আরো আরো তীব্রভাবে সমস্ত এলজিবিটিকিউআই প্লাস (LGBTQI+) কমিউনিটির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাক। এতটা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে যাক, যেন ওঁরা মরার আগে নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রচন্ড পোক্ত করে ফেলে। আমি চাই, এই ভয় এতটা সংক্রামক হোক যেন সমস্ত রূপান্তরিত মানুষ নিজের সার্জারির আগে কেরিয়ার তৈরি করুক, সেভিংস করুক, হেল্থ ইন্সুরেন্স থাক... বিশ্বাস করুন ব্যাংকে টাকা থাকলে আপনি যে কেউ হন, যা খুশি হন, পৃথিবী আপনাকে সেলাম করবে। আমি চাই প্রত্যেকটি মানুষ ফিনান্সিয়ালি স্টেবল হোক, তবে রূপান্তরিত বা রূপান্তরকামী মানুষেরা যেন অবশ্যই আর্থিকভাবে প্রচুর সফল হয়— যাতে শেষযাত্রায় চিকিৎসাটুকু পেয়ে মরতে পারে।’
বন্যা সবশেষে লেখেন, ‘তুমি সার্জারি করাও ছাই না করাও, তোমাকে এই সমাজ কোনোদিনই পুরো নারী বা পুরো পুরুষ বলবে না। ছক্কা বা হিজড়াই বলবে। কিন্তু এতটা সফল হও, যাতে তারা তোমাকে ছক্কা-হিজড়া বলার পরও, তোমাকে হিংসা করে।’