বাড়ি থেকে অফিস, খেলার ময়দান থেকে ব্যবসা- বর্তমান সময়ে মহিলারা পিছিয়ে নেই কোনও কিছুতেই। কিন্তু যেখানে দাঁড়িয়ে আজও কোথাও গিয়ে শুনতে হয় ‘বাঙালিদের দ্বারা ব্যবসা হয় না’, সেখানে নারী দিবসের ঠিক প্রাক্কালে ব্যক্তিগত সমস্যা সামলে নিজের ‘ব্র্যান্ড’ তৈরি করার গল্প শোনালেন দেবযানী রায়চৌধুরী। দীর্ঘ সাত বছরের লড়াইয়ের কথা শুনল হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা।
ব্যবসায় আসার কথা কখন এবং কেন ভেবেছিলেন?
দেবযানী রায়চৌধুরী: আমি আগে চাকরি করতাম। একটি হাইস্কুলের শিক্ষিকা এবং কাউন্সিল ফর ইন্ডিয়ান স্কুল সার্টিফিকেট এক্সামিনেশনের এক্সামিনার ছিলাম। সন্তান হওয়ার পর তাকে সময় দেওয়ার জন্য ব্রেক নিয়েছিলাম। আর তাছাড়া, পড়ানো কাজটা আমার খুব একঘেয়ে লাগত। ক্রিয়েটিভ কিছু করার থাকে না ওই এক গতে বাঁধা পড়ানো ছাড়া। আর যে কাজ একঘেয়ে সেটা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। এখন যেটা করছি সেখানে যেহেতু প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন বানাতে হয় এই একঘেয়েমিটা আসে না। ভালো লাগে করতে। সেখান থেকেই সাত বছর আগে ব্যবসায় শুরু করি।
আরও পড়ুন: চাকরি জীবন ছেড়ে 'নিজের কিছু' করার ভাবনা দিয়ে শুরু, আজ অন্যের ব্যবসাকে 'মাত্রা' দিচ্ছেন দীপান্বিতা!
৯-৫ টার চাকরি জীবন ছেড়ে ব্যবসা! কেন?
দেবযানী রায়চৌধুরী: আমি ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে। বাবা, কাকা সবার ব্যবসা আছে। ফলে এই জগতটা আমার কাছে নতুন নয়। কিন্তু আমার যে প্রথম থেকেই ব্যবসা করব এমন ভাবনা চিন্তা ছিল, সেটা কিন্তু একদমই না। আগ্রহ ছিল না তেমন। এমনকি বাবার ব্যবসাতেও কখনও খুব একটা মন দিইনি। কিন্তু পরবর্তীতে আমার মনে হয় ব্যবসার মধ্যে প্রচুর চ্যালেঞ্জ আছে। আর এই চ্যালেঞ্জটা ৯-৫ টার চাকরির মধ্যে পাওয়া যায় না। তাছাড়া, ব্যবসায় একটা স্বাধীনতা আছে যেটা আমি কোথাও চাকরি করতে গেলে কেউ দেবে না। কারও কাছে কাজ করতে যাওয়া মানে আমার যত রিসোর্স আছে আমি সব তাঁর জন্য দিয়ে দিচ্ছি, তাঁর গ্রোথের জন্য দিচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত ভাবে কোনও গ্রোথ হয় না তাতে। কিন্তু ব্যবসাতে আমি নিজে তো গ্রো করতে পারিই, আবার একই সঙ্গে, যাঁরা আমার সঙ্গে কাজ করেন মানে তাঁতি, কারিগর তাঁদের যখন আমার সঙ্গে গ্রো করতে দেখি তখন আলাদা একটা শান্তি পাই। এটা একমাত্র ব্যবসা করতে করতেই উপলব্ধি করা যায়। যখন ব্যবসা শুরু করে কেউ তখন হয়তো এত ভাবে না, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বোধগুলো আসে, আর এগুলো একটা আলাদাই সাহস জোগায়, আত্মবিশ্বাস জোগায়। তৃপ্তি দেয়।
একেবারে শূন্য থেকে ডিজাইনিং-বুটিকের দুনিয়ায় নিজের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন?
দেবযানী রায়চৌধুরী: যখন পড়াতাম সেই সময় যে টাকা জমিয়েছিলাম সেটাকেই মূলধন করে ব্যবসাকে দাঁড় করিয়েছি। একসঙ্গে অনেক টাকা ঢেলেছি সেটা কিন্তু নয়। প্রতি মাসে একটু একটু করে টাকা ঢালতাম। যেটা প্রফিট হতো সেটাকে আবার সার্কুলেট করতাম এটার মধ্যেই। কিন্তু পরবর্তীকালে ব্যবসাকে স্কেল আপ করতে একটু অসুবিধায় পড়তে হয় আমায়। একটা সময় ব্যবসায় প্ল্যাটো আসে। সেই সময় ব্যবসাকে স্কেল আপ করার জন্য অনেকটা টাকার দরকার হয়। সেটার অসুবিধা হয়েছিল। এছাড়া ব্যক্তিগত কারণও ছিল। ডিভোর্সের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। তো সেই সময় এই ব্যবসার টাকা থেকেই বাড়ি চালানো, মেয়ের পড়া, ইত্যাদি সবই করতে হয়েছে। এই ব্যবসা থেকেই গাড়ি, বাড়ি করেছি। এটাকে আমি আমার নিজের আরেকটা মেয়ে মনে করি। আমার ছোট মেয়ে। এটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে পরিমাণ টাকার দরকার ছিল সেটার জন্য ইনভেস্টর প্রয়োজন ছিল। তখন উঠে পড়ে লেগেছিলাম ইনভেস্টর পাওয়ার জন্য। ফলে ব্যক্তিগত কারণের জন্যই যতটুকু যা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। নইলে যে তেমন কোনও সমস্যায় পড়তে হয়েছে সেটা নয়।
যাঁরা আগামীতে ব্যবসায় আসতে চান, বা সদ্য এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাঁদের জন্য কী টিপস দেবেন?
দেবযানী রায়চৌধুরী: ভিতর থেকে চাইতে হবে। অন্যেরা করছে বলে আমায় করতে হবে এমনটা করলে হবে না। নিজের ভিতরের চাহিদা হতে হবে ব্যবসা করার জন্য। 'কিছু অর্জন করতে হবে', ভিতরে এই খিদে না থাকলে, বা এটা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই, অন্য অপশন নেই এই ভাবনা না থাকলে ব্যবসা করা যাবে না। আমায় একবার এক ইনভেস্টর বলেছিলেন 'আপনি তো শিক্ষিকা ছিলেন, আবারও তো শিক্ষকতায় ফিরে যেতে পারেন', আমি ওঁকে বলেছিলাম 'আমি এটাই জানি। এটা ছাড়া অন্য কিছু করতে পারব না'। ভিতরে সেই জেদ যতক্ষণ না আসবে যে আমি ব্যাবসাই করব। অন্য কিছু করতে পারব না ততক্ষণ হবে না। প্যাশন না থাকলে একটা সময়ের পর গিয়ে সেটা কোথাও থমকে যায়।