চিনের ডায়েরি (প্রথম পর্ব)
কাশ্মীরে উগ্রপন্থা এবং কান টানলে মাথা আসার মতো পাকিস্তানি বজ্জাতি খানিকটা জব্দ সবে করা হয়েছে কী হয়নি, তার মধ্যেই, এই কদিন আগে চিন ফের অরুণাচল প্রদেশের ২৭টি জায়গার নতুন নতুন চিনা নাম ঘোষণা করল। পাহাড়, নদী, গিরিপথ, এমনকী ছোট ছোট গ্রামও বাদ গেল না। হাফ তিব্বতি- হাফ ম্যান্ডারিন, এই বকচ্ছপ নামগুলো অনেকটাই হিমানীশবাবুর ‘চাইনিজ সিঙাড়া’ এবং ‘চায়ে নিজ সিঙাড়ার’ মতো।
অরুণাচলের এই অঞ্চলকে চিন অনেক দিনই ‘জাংনান’, অর্থাৎ ‘দক্ষিণ তিব্বত’ বলতে শুরু করেছিল। ভারত-তিব্বত সীমান্ত জুড়ে তারা ইচ্ছে মতো নাম বদলেছে আগেও। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্তমানের এই দ্রুত পরিবর্তনশীল জিও-পলিটিক্সে বিষয়টা সাবধান হওয়ার মতো বৈকি। তিব্বত দখলের আগেও চিন ঠিক এই খেলাই খেলেছিল। তাই আমাদের বোঝা উচিত, এই নামকরণ আসলে এক অশনি সংকেত—এক ধাপে ধাপে আগ্রাসনের চেনা চৈনিক ছক। প্রথমে নাম বদল, তারপর মানচিত্রে নতুন দাগ, তারপর সামরিক উপস্থিতি। ব্যাস, ঐতিহাসিক তিব্বত ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছিল আধুনিক চিনের ‘শিচাঙ’-এ।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এলাকা দখল নেওয়ার আগে তার নাম বদল ঘটা করে ঘোষণার খেলা নতুন কিছু নয়। ১৯৩৮ সালে, নাৎসি জার্মানি ১,৫০০টিরও বেশি স্থানের নাম পরিবর্তন করে। এই নামগুলি পূর্বে প্রুশিয়ান, লিথুয়ানিয়ান ও পোলিশ উৎসের ছিল। তাদের জার্মানিকরণ করা হয়। এই পদক্ষেপটি ছিল হিটলারের আসন্ন আগ্রাসনের একটি ট্রেলার। চিন বর্তমানে সেই খেলাটিই খেলছে। একটা জায়গার নাম এবং সেই সঙ্গে তার অর্থ বদলে দিতে পারলে কেবল রাজনৈতিক নয়, ধীরে ধীরে জনগণের মানসিক ভূগোলও পালটে যায়। একথা চিনের থেকে ভালো কেউ বোঝে না।
আমাদের দেশে, আমাদের সরকার বাহাদুরও এই নাম বদলে দেওয়ার কর্মসুচী (ইতিহাসের কিছু অপ্রিয় অধ্যায় পাঠ্য পুস্তক থেকে মুছে দেওয়ার পাশাপাশি) নিয়েছে। ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়ালের মতোই— এলাহাবাদ থেকে প্রয়াগরাজ, কিংবা মুঘল সরাই জংশন থেকে দীনদয়াল উপাধ্যায়— এ তো আমরা হামেশাই দেখছি। তবে চিনের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য একটাই— আমরা জায়গার নাম বদলাই অতীতের কোনও একটা অস্বস্তিকর অধ্যায় অস্বীকার করার প্রচেষ্টায়, আর চিন সেটা করে ভবিষ্যতের আগ্রাসনের পথ সুনিশ্চিত করতে।
‘মেরে মুখের জিওগ্রাফি বদলে দেব’- এই কথাটা আজকাল খুব একটা শুনতে পাই না, কিন্তু তিব্বতের দিকে তাকালে দিব্যি দেখতে পাই। দেখতে পাই তিব্বতকে কুচি কুচি করে কেটে এক নতুন চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস বানানো হয়েছে। ঐতিহাসিক ভাবে মূলত তিনটি অঞ্চল ছিল তিব্বতে— উ-চাং, খাম, আর আমদো। এদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। উ-চাং এর প্রাণকেন্দ্র লাসা-র পঞ্চত্বপ্রাপ্তির কথা বাদ দিলাম, খাম আর আমদোকে টুকরো করে সিচুয়ান, ইউনান আর ছিংহাই প্রদেশের মধ্যে এমন ভাবে ভাগ করে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে- যেন এক নতুন রেসিপি বানানোর এক্সপেরিমেন্ট।
প্রাচীন খাম প্রভিন্সের রাজধানী চামদোর কথাই ধরা যাক। ১৯৫০ সালে, ঠিক স্বাধীন ভারতের জন্মলগ্নে, পিপলস লিবারেশন আর্মি অভিযান চালিয়ে চামদো দখল করে। দালাই লামার দূতেরা তখনও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলছিলেন। কিন্তু সেনাবলে শক্তিশালী চিন জানত, রাস্তা কোথায় বানাতে হবে, ব্রিজ কোথায় বসাতে হবে। তাই চামদো আজ আর ‘চামদো’ নেই—এখন সেটি ‘Changdu’, তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একটি প্রিফেকচার, মানে একরকম জেলা। ম্যান্ডারিন নামধাম এবং নতুন প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে এক সময়কার স্বাধীনতাপ্রিয়, সাহসী খাম্পাদের শেষ চিহ্নটুকুও এখানে আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আর বর্তমান দালাই লামার জন্মস্থান আমদো? চিনের ম্যাপে এটি আজ ‘ছিংহাই’। একেবারে আলাদা এক প্রদেশ। সরকারি হিসেবে এখানে তিব্বতিরা এখন সংখ্যালঘু। স্কুলে ম্যান্ডারিন, রেডিয়ো-টিভিতে ম্যান্ডারিন, আদালতে ম্যান্ডারিন। কুমবুম মঠ, যা এক সময় তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের এক উজ্জ্বল কেন্দ্র ছিল, আজ ম্যান্ডারিনে লেখা পর্যটন সাইনবোর্ডে সে পরিচিত “Ta’er Si" নামে।
আমাদের বোঝা উচিত, এই ঘটনাগুলো কেবল অতীতের ছায়া নয়— এরা ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। আজ অরুণাচলের যেসব স্থান— যেমন তাওয়াং, বুমলা, কিংবা কিবিথু— নতুন করে চাইনিজ নাম পাচ্ছে, তা নিছক ছেলেখেলা নয়, বরং সেই পুরনো ছায়াযুদ্ধেরই পুনরাবৃত্তি, যা একদিন তিব্বতের জনপদগুলির ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল।
আপাতত অরুণাচলের মাটিতে চিনা সৈন্যের বুট পড়ছে না ঠিকই, কিন্তু মানচিত্রে, স্যাটেলাইট চিত্রে, আর আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিত্যনতুন নামকরণের মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ব্লু-প্রিন্ট মেনে এগিয়ে চলেছে। আমরা বলছি ঠিকই— অরুণাচল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কিন্তু প্রতিবেশী তিব্বতের সাম্প্রতিক ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, বাকযুদ্ধ, মিডিয়া স্টেটমেন্ট ইত্যাদি কখনও শেষ কথা নয়। বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যখন চিন। তারা যদি সীমান্ত পার না করেই আমাদের দেশের জায়গার নাম বুক ফুলিয়ে বদলে দিতে পারে, মানচিত্র নিজের মতো করে আঁকতে পারে— তবে বুঝে নিতে হবে অরুণাচলে ম্যান্ডারিন ভাষার আগমন এবং সেই ভাষার ভূখণ্ড দখলের খেলা চিন শুরু করে দিয়েছে।
#
পরাজিত তিব্বতের খণ্ডিত ভূগোল আর নতুন নামের মুখোশের অন্তরালে ছিল আর একটা অদৃশ্য যুদ্ধ— ভাষার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে তিব্বতিদের মুখের, মনের, এমনকী প্রার্থনার ভাষা— দ্রুত সবই বদলে গিয়েছিল। এই যুদ্ধের নাম ‘ভাষা রাজনীতি’। আর তাতে চিনের প্রধান অস্ত্র? অত্যাধুনিক ড্রোন নয়, সেই অস্ত্র হান চিনাদের ভাষা— যার নাম ম্যান্ডারিন।
চিন জানে, কোনও জাতিকে ভাঙতে চাইলে, তার ভূখণ্ড দখলের আগে তার আত্ম-পরিচয়ে চিড় ধরানো দরকার। একটা মানুষের আত্মপরিচয় এবং একটা জাতীয় আইডেন্টিটির কেন্দ্রে থাকে তার নিজস্ব ভাষা। তাই তাকে অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করে মুছে দেওয়া দরকার। তিব্বতী শিশুরা এক সময় প্রাতঃস্মরণে উচ্চারণ করত তাদের মঠের গুরুদের শেখানো তিব্বতি মন্ত্র। এখন তারা স্কুলে ম্যান্ডারিন ভাষায় পড়ছে ‘জাতীয়তা’, ‘সভ্যতা’, ‘উন্নয়ন’-এর পাঠ। তাদের বইতে তিব্বতি সংস্কৃতির উল্লেখ সীমিত, তিব্বতি ভাষা এখন ঐচ্ছিক, আর শিক্ষকরা বড় শহর থেকে আসা ‘হান’, ম্যান্ডারিনভাষী কর্মী। ফলে এখনকার তিব্বতিদের অনেকেই তিব্বতি লেখায় দুর্বল। কেউ কেউ শুধু বলতে পারে, লিখতে পারেই না। শহরের দোকানে সাইনবোর্ড শুধু ম্যান্ডারিনে। সরকারি কাজকর্ম, জমির দলিল, আদালতের মামলা— সবই সেই ভাষায়। এমনকী ধর্মীয় মঠের অনুষ্ঠানেও এখন স্থানীয় তিব্বতি শব্দ কম, ম্যান্ডারিন নির্দেশ বেশি। যারা প্রতিবাদ করে, তাদের ‘পুনঃশিক্ষা’-র নামে পাঠানো হয় বিশেষ শিবিরে। হীরক রাজার মগজ ধোলাই যন্ত্রের মতো অব্যর্থ কাজ করে এই সব শিবির।
এই যে ধীরে ধীরে এক ভাষাকে সরিয়ে আর এক ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া, এটা নিছক ‘প্রশাসনিক’ পদক্ষেপ নয়। এটা এক জাতির মস্তিষ্কে নিজেদের ছাপ ফেলার কৌশল। আর একবার যদি ভাষা বদলে যায়, তাহলে ইতিহাস তো কোন ছাড়, জাতীয় স্মৃতি মুছে যায়, আত্মপরিচয় ফিকে হয়ে যায়। মাতৃভাষার ভিতরে থাকে জাতির আত্মা। সেই আত্মাকেই যদি হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের মতো প্রতিস্থাপন করে দেওয়া যায়, তখন আর সীমান্তে যুদ্ধ লাগে না— মনের মানচিত্র, দেশপ্রেম ইত্যাদি আপনা থেকেই নতুন ক্যানভাস খুঁজে নেয়। যুদ্ধ যখন শেষ হয়, পরাজিত পক্ষকে বেঁচে থাকার জন্য কিছু ফান্ডামেন্টাল জিনিস মেনে নিতে হয়। প্রাণ বড়, না নিজের জাতীয় পরিচয়? তাই অরুণাচলে চিনা নাম দেখে যাঁরা বলছেন, ‘নামে কী আসে যায়?’, তাঁদের জন্য তিব্বত এক জলজ্যান্ত শিক্ষা হওয়া উচিত। ওরা আজকে নতুন নামের লিস্ট দেখিয়েছে, আগামিকাল জনচেতনাও বদলে দেবে। তিব্বতকে গিলে খাবার পর থেকেই চিনের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। আর ভারতের পাশে কেউ আদৌ আছে কি?
(এর পরের পর্বে অবশ্য জিও-পলিটিক্স নয়, আধুনিক চিনের সাম্রাজ্যবিস্তারের অন্যতম প্রধান অস্ত্র, সেই ম্যান্ডারিন ভাষার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের গল্পটাই বলব। ২০১৫ সালে, এক উদ্ভট খেয়ালে আমি চিন গিয়েছিলাম। এমনি বেড়াতে নয়, উদ্দেশ্য ছিল রীতিমত একটা এক্সপ্লোরেটরি কিছু করব। যেহেতু আমাকে টুরিস্ট সার্কিটের বাইরে গিয়ে, একেবারেই পাড়াগাঁয়ের মানুষের সঙ্গে ওঠা বসা করতে হবে, তাই যাবার আগে একটু ম্যান্ডারিন শিখে নেওয়া উচিত বলেই মনে হয়েছিল। ইউনান প্রদেশের মানচিত্রে, চিনশা নদীর দ্বিতীয় গ্রেট বেন্ডে, একটা ছোট্ট শূন্যস্থান পূরণ করতে পেরেওছিলাম শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সে একেবারেই অন্য গল্প। তাই এবারের আড্ডা না হয় হিমানীশ বাবুর চাইনিজ শিঙাড়া এবং চায়ে নিজ শিঙাড়ার থিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক)
(মতামত ব্যক্তিগত)