- সোনালি বিশ্বাস
সমাজকর্মী, লেখিকা, সম্পাদক
কিছুদিন আগেই ইন্দো-পাক অশান্তির আবহে মক ড্রিলের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। ৫৪ বছর আগে শেষ বড় যুদ্ধ দেখেছিল পশ্চিমবঙ্গ। মক ড্রিল শুনেই অনেকে ফিরে যাচ্ছেন ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিতে। রাতের সাইরেন, কালো কাগজ দিয়ে কাচ ঢেকে রাখা, ব্ল্যাক আউট হয়ে যাওয়ার নানা স্মৃতি, ভিড় করছে মনে। তবে বাংলাদেশ গঠনের আগে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলার পরিস্থিতি কিছুটা অন্যরকম ছিল। তখন মানুষের মনে ভয় ছিল না, বরং ছিল পড়শি ভূখণ্ডে নতুন নির্মিত হতে চলা রাষ্ট্রটির প্রতি অতল সমবেদনা। দেশভাগ হয় ১৯৪৭ সালে। বহু মানুষ ✤সেই সময় কাঁটাতার পেরিয়ে চলে আসেন এপার বাংলায়। তার পরেও ওপারে থেকে গিয়েছিলেন অনেকে। ১৯৭১-এ নৃশংসভাবে নির্বিচারে নিধনযজ্ঞে নেমেছিল খানসেনা। বাংলাদেশ গঠনের আগে তাই এপার বাংলার দুশ্চিন্তা ছিল ওপার বাংলার আত্মীয়দের নিয়ে।
- মুক্তিযুদ্ধের সাইরেন আবেগের সংকেত
১৯৭১ সালের ভারত পাক যুদ্ধের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করা চলে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় কম দিন ব্ল্যাক আউট হয়েছিল— শেষের দিকে, ডিসেম্বর মাসের শেষ দশ-বারো দিন। মক ড্রিলের কথা ভালো মনে নেই, তবে ওই সময় মানুষ ব্ল্যাক আউট, সাইরেনের সঙ্গে বেশ পরিচিত। তার বড় কারণ ১৯৬২ সালের ইন্দো–চিন অশান্তির আবহ। এছাড়়াও, ১৯৬৭ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের সময় ক্ষণে ক্ষণে সতর্কতা জারি করত সরকার। ফলে তখন থেকেই একটা অভ্যাস। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাইরেনের আওয়াজে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা মাথাচাড়়া দিত না। বরং গোটা বাংলা তখন আরেক বাংলার জন্য আবেগে উদ্বেল। খবর বলতে খবরের কাগজ আর অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো। রেডিয়োতেও তখন নতুন এক রাষ্ট্র নির্মাণের উত্তেজনা সঞ্চালকের কণ্ঠে। মাঝে মাঝেই বাজছে বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান। মুজিব সম্পর্কিত ঘোষণা, বুলেটিন। প্রবাদপ্রতিম দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা এই প্রসঙ্গে না বললেই নয়। তাঁর কণ্ঠ সমূহ আবেগের পারদ চড়়িয়েছে নিয়মিত। মুক্তিযুদ্ধের আবেগের পরিপ্রেক্ষিতে অংশুমান রায়ের একটা গান ছিল— ‘শোন একটি মুজিবের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের༒ ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশ বাতাসে উঠে’ ..... সে গান সর্বত্র বাজানো হত। বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল ওই গান। মুজিবুর রহমানের শেষ বক্তৃতা— ‘আমরা ভাত মারব, পানিতে মারব, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না, জয় বাংলা।’ এখনও মনে করলে গায়ে কাঁটা দেয়। এগুলও আবেগ।
- বহুদিনের অভ্যাস বাঙালির
ব্ল্যাক আউট, সাইরেনের সঙ্গে ঘর করার অভ্যাস বাঙালির বহুদিনের। বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই। ষাটের দশকের যুদ্ধের সময়ে আমি স্কুলে পড়ি। বাবার কাছে শুনেছিলাম বিশ্বযুদ্ধের গল্প। তখন মাঝে মাঝেই গুজব রটত, জাপানিরা নাকি বোমা ফেলবে কলকাতায়। ফলে ব্ল্যাক আউট, সাইরেন, হন্তদন্ত হয়ে নিরাপদ স্থানে ছুটে যাওয়া। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ষাটের দশকের দিনগুলি বেশ মনে আছে। ঘ💟রে বসে পড়াশোনা করছি সন্ধেবেলা। হঠাৎ সাইরেন বেজে উঠল। একটা সময় সাইরেনের সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা মেলানোর অভ্যাস হয়ে গেল। নটা বাজলেই সাইরেনের শব্দ। ব্যস, বইপত্র গুটিয়ে রেখে নিচে গিয়ে জড়ো হওয়া।
- ব্ল্যাক আউটের খণ্ডচিত্র
তখন যারা তরুণ ছিলেন, বর্তমানে তারা কাটিয়ে ফেলেছেন অর্ধশতাব্দী। ফলে স্মৃতি কিছুটা ভঙ্গুর হতে পারে। ব্ল্যাক আউট, সাইরেন বলতেই কিছু খণ্ডচিত্র ভেসে ওঠে চোখের সামনে। হঠাৎ একটানা বিকট আওয়াজ, সন্ধে হলে রাস্তার নিয়ন আলো নিভিয়ে রাখা। বাড়িতে বাড়িতে দরকারের বেশি আলো জ্বালার রেওয়াজ নেই। যাদের কাচের জানালা ছিল, তাদের ♐আবার কালো কাগজ সাঁটতে হত। সাধারণত রাতের দিকেই বেশি বাজত সাইরেন। আর বাজলেই নিরাপদ কোথাও গিয়ে জড়ো হও। যারা দোতলা, তিনতলায় থাকতেন, তারা এসে জড়়ো হতেন রাস্তায়। ষাটের দশকের ইন্দো পাক যুদ্ধ ও ইন্দো চিনের যুদ্ধের সময় কোনওদিনই তেমন কোনও আক্রমণ হয়নি কলকাতায়। কিন্তু ব্𝓡ল্যাক আউট, সাইরেনে ভয় লাগত না বললে ভুল বলা হবে। ভয় আসলে অভ্যাস হয়ে উঠেছিল। হয়ে উঠেছিল রোজনামচা। উলুখাগড়ার জীবনে যেমনটা হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক।
প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব
(অনুলিখন - সংকেত ধর)